কাজী আরেফ হত্যাকান্ডে ৩ জনের ফাঁসি কার্যকর

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.01.07
BD-Kaji-Aref বৃহস্পতিবার রাতে কাজী আরেফ হত্যাকান্ডে কুষ্টিয়ার সাফায়েত হোসেন হাবিব, আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টুর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
অনলাইন

বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা। সেসব রায় কার্যকরও হচ্ছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ ও কুষ্টিয়া জেলা জাসদের ৫ নেতার তিন খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে বৃহস্পতিবার রাত ১১ টা ৩ মিনিট থেকে ১১ টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে এ তিন আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে ক্রমাগত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা বাড়ছে। আগে বছরে এ ধরনের দু চারটা ফাঁসির ঘটনাতেই আলোড়ন পড়ত। এখন বছরে গড়ে ২০ থেকে ২৫টির মত ফাঁসির ঘটনা  ঘটলেও ততটা আলোড়ন লক্ষ্য করা যায় না। আর বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারের কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ৯১৫ জন আসামি।

তবে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিয়ে খুব বেশি আপত্তি না দেখালেও অন্যান্য ফাঁসির ব্যাপারে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রশ্ন রয়েছে।

মূলতঃ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকেই ফাঁসির সংখ্যা বেড়ে যায় বলে বিশ্লেষণে দেখা গেছে। তখন নাটোরে একটি মামলার রায়ে ২১জনকে ফাঁসি দেওয়ার হয়।  

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫ সালে জুলাই পর্যন্ত ৪৪ বছরে  মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ৪৭৮ জনের। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, কনডেম সেলে থাকা ফাঁসির ৯১৫ আসামির মধ্যে আজ পর্যন্ত হাইকোর্টে ৪০৩ জনের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আর সর্বোচ্চ আদালতের নিষ্পত্তির পর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় ৩২৪ জনের।

এছাড়া নিম্ন আদালতগুলোতে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আরও ১৮৮ জনের ফাঁসির দণ্ড অনুমোদনের জন্য উচ্চ আদালতে (ডেথ রেফারেন্স) যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, মামলাজট ও বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণে নিম্ন আদালতে দণ্ড ঘোষণার পর উচ্চ আদালতে সাজা মওকুফ বা আপিলের কারণে ফাঁসি কার্যকরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত সময় চলে যায়।


ফাঁসির আদেশ মাথায় নিয়ে কারাগারে এক দশক

কারা অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশের কারাগারগুলোর কনডেম সেলে থাকা ৯১৫ জনের মধ্যে  ৮ থেকে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কনডেম সেলে আটক আছেন অনেকেই। উদাহরণস্বরূপ গত ১০ বছরেও কার্যকর হয়নি চাঞ্চল্যকর আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ১৮ জনের রায়। ২০০৫ সালে ওই মামলায় ১৮ জনের ফাঁসির দণ্ড দেন আদালত। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও এসব আসামি এখনও কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।

ফাঁসির আসামিদের বিষয়ে ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার জানান, প্রতি মাসে একবার ফাঁসির আসামিদের তালিকা করা হয়। চূড়ান্ত রায়ের পর তাদের নামের তালিকা কারা অভ্যন্তরে টাঙিয়ে দেয়া হয়। তালিকার  ক্রমিক অনুযায়ী তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কারাবিধি অনুযায়ী কোনো ফাঁসির আসামির ব্যাপারে সর্বশেষ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের তারিখ থেকে ২১ দিনের আগে তা কার্যকর করা যায় না। আবার ওই সময়ের ২৮ দিনের মধ্যেই তা কার্যকর করতে হয়। তবে কারাগারে ফাঁসির আসামিদের সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে।


ডেথ রেফারেন্সের নিষ্পত্তির হার কম

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর উচ্চ আদালতে যে হারে ডেথ রেফারেন্স মামলা আসে সে তুলনায় নিষ্পত্তি হয় অনেক কম। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, নিম্ন আদালতের দেয়া ফাঁসির দণ্ড অনুমোদনের জন্য ২০১৫ সাল পর্যন্ত হাইকোর্টে ৮৪৭টি ডেথ রেফারেন্স এলেও এ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৪০৩টি। বাকি ৪৪৪টি ডেথ রেফারেন্স এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলার স্তূপ থাকার পেছনে এতদিন প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক আদালত এবং সরকারি প্রিন্টিং প্রেস (বিজি প্রেস) কর্তৃক পেপার বুক তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করা হতো। এ অবস্থায় মামলাজট কমাতে উচ্চ আদালত থেকে পেপার বুক তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য সরকারকে বিশেষায়িতভাবে নিজস্ব মেশিন ক্রয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়। সরকার ২০১৪ সালে উচ্চ আদালতের জন্য প্রায় ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনটি ডিজিটাল ডুপ্লিকেটিং মেশিন ক্রয় করে এসব প্রক্রিয়া বিশেষ ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসে। আর এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের মামলাজট অনেকটাই কমতে শুরু করেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট মহলের।


সবচেয়ে বেশি ফাঁসির আসামি কাশিমপুর কারাগারে

জানা গেছে, দেশের কারাগারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে গাজীপুরস্থ কাশিমপুর কারাগারে। এটি দেশের একমাত্র ও সর্বাধুনিক নিরাপত্তা সংবলিত হাই সিকিউরিটি কারাগারের কনডেম সেলে বর্তমানে ৪৪৮ জন ফাঁসির আসামি রয়েছেন। এদের মধ্যে ৪১৫ জন পুরুষ ও ৩৩ জন নারী। এছাড়া কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২-এ রয়েছে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ৯০ পুরুষ আসামি। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের পার্ট-১-এ ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামি রয়েছে ২৫ জন পুরুষের। এর বাইরে দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে ৬৪টি কারাগারে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ৩১৭ জন আসামি কনডেম সেলে অবস্থান করছে। আর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন ৩৮ জন। এদের মধ্যে ২৮ জন পুরুষ আর ১০ জন নারী।


আরেফ হত্যায় তিনজনের ফাঁসি কার্যকর

এদিকে, বৃহস্পিতবার মধ্যরাতে সতের বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা কাজী আরেফ আহমেদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির সাজা কার্যকর করা করা হয়েছে।

এই তিনজন হলেন- কুষ্টিয়ার মীরপুর উপজেলার রাজনগর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে সাফায়েত হোসেন হাবিব, কুর্শা গ্রামের উম্মতের ছেলে আনোয়ার হোসেন ও আবুল হোসেনের ছেলে রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু।

১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জনসভায় ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ হারান কাজী আরেফ আহমেদ, কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরাইল হোসেন ও সমশের মণ্ডল।

ওই ঘটনার পরদিন দৌলতপুর থানার এসআই মো. ইসহাক আলী বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। আলোচিত এ মামলার রায়ে ২০০৪ সালের ৩০ অগাস্ট কুষ্টিয়া জেলা জজ আদালত ১০ জনের ফাঁসি এবং ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়।

ওই রায়ে ইলিয়াস, রাশেদুল ইসলাম ওরফে ঝন্টু, সাফায়েত হোসেন (হাবিব), আনোয়ার হোসেন, সাহির হোসেন, মান্নান মোল্লা, বাকের, রওশন, জাহান ও জালালের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।  এছাড়া রাফাত ওরফে রাফা, গারেস, তাসিরুদ্দিন, আসগর জোয়ারদার, নজরুল ইসলাম, ওয়ালিউর রহমান, একুব্বার, টিক্কা ওরফে জাব্বার, লাবলু, ফিরোজ ওরফে ফরু, লাল্টু ওরফে নুরুজ্জামানকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের কয়েকজনের আপিলের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট ২০০৮ সালের ৩১ অগাস্ট নয় জনের মৃত্যুদণ্ড ও তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখে। হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ২০১১ সালের ৭ অগাস্ট পাঁচজনের ফাঁসি এবং সাতজনের যাবজ্জীবনের রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ইলিয়াস হোসেন মারা গেছেন আর মান্নান মোল্লা পলাতক। বাকি তিনজনের মধ্যে আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করলেও গতবছর ১৯ নভেম্বর তা খারিজ হয়ে যায়।


মানবাধিকার কর্মীদের আপত্তি

সংশ্লিষ্টদের মতে, অপরাধের মাত্রা এবং ধরন বাড়ার কারণে মৃত্যুদন্ডের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে  মৃত্যদন্ড বাড়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। মামলার দীর্ঘসূত্রিতার সমালোচনাও করেছন তারা।

এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, অন্যায়ের মাত্রা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু ফাঁসির মাধ্যমে আসামিকে হত্যা করাই কোন সমাধান নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তরুণরা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বিচারের মাধ্যমে তাদের ফাঁসি দিয়ে জীবন কেড়ে নেওয়া সমাধান নয়। বরং নির্দিষ্ট সাজা ভোগের পর তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

এছাড়া ডেথ রেফারেন্স মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন,  ডেথ রেফারেন্স মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। এতে  করে দোষীরা সাজা পাবে আর নিরপরাধীদের মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। নিরপরাধ হয়ে একজন ব্যক্তিও যাতে ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কনডেম সেলে দিন পার না করে সে বিষয়টিতে কর্তৃপক্ষকে মনোযোগী হতে হবে।


বিএনপির আমলে এক মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদন্ড

২০০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বিএনপির সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সাব্বির আহম্মেদ ওরফে গামা নাটোরে তার নিজ বাড়ির অদূরে কামারপাড়া মোড়ে খুন হন। ঘটনাস্থলের পাশেই ছিল অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি। দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর সর্বহারাদের নামে স্লোগান দিতে দিতে চলে যায়।

ওই মামলায় ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত একই পরিবারের ১৩ জনসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। এদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। এর প্রায় ছয় বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ওই ২০ জনসহ ২১ জনের ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।